শিক্ষকতা পেশা শুধু পেশা নয়
শিরোনামটি হয়তো একটু একপেশে হয়ে গেল। আসলে কোনো পেশাই শুধু পেশা নয়। অর্থাৎ পেশা একজন মানুষকে শুধু টাকাকড়ি নয়, একটা উদ্দেশ্য, একটা পরিচয় বা জীবনের একটা অর্থও প্রদান করে। একজন মানুষের জীবনে তার পেশা যে আসলে কতটা প্রভাব ফেলে, এর সাক্ষাৎ প্রমাণ অস্ট্রিয়ার একটা ছোট্ট শহর মেরিয়েন্থালের অধিবাসীদের জীবনে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা। ১৮৩০ সালে ওই শহরে একটা তুলা কারখানা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে ওখানকার বেশির ভাগ লোক ওই কারখানাতেই চাকরি করতেন। ভালোই চলছিল, কিন্তু ১৯৩০-এর দশকের মহামন্দায় সেটা বন্ধ হয়ে যায় এবং মেরিয়েন্থালের তিন–চতুর্থাংশ লোক চাকরি হারান। অবশ্য বেকার ভাতা পেতেন বলে চাকরিচ্যুত ব্যক্তিদের আর্থিক অসুবিধা হয়নি। তবে এই ভাতা পাওয়ার একটা শর্ত ছিল। অন্য কোনোভাবে অর্থ উপার্জন করা যাবে না। এক লোক হারমোনিকা বাজিয়ে শুধু কিছু বকশিশ নেওয়াতেই তাঁর ভাতা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
১৯৩০ থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত গ্রেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু গবেষক চাকরিচ্যুত মেরিয়েন্থালবাসীর ওপর একটা গবেষণা করেন। গবেষকরা তাঁদের মধ্যে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন দেখতে পান। যাঁরা হাঁটতেন, তাঁরা আর হাঁটেন না, যাঁরা হাইক করতেন, তাঁরা আর হাইক করেন না, সারা দিন কেবল ঝিমান। কেউ আর হাতে ঘড়িও পরেন না, কোথায় কত সময় যায়, তাতে আর কীই-বা আসে-যায়! গিন্নিদের অভিযোগ, যাওয়ার কোনো জায়গা নেই, তবু তাঁদের স্বামীরা দেরি করে বাড়ি ফেরেন। ছবি এঁকে কিংবা বইপত্র পড়েও এই অখণ্ড অবসরকে কাজে লাগানো যেত। কিন্তু দেখা গেল, আগে এসবের যতটা চর্চা ছিল, তা-ও কমে গেছে। স্থানীয় লাইব্রেরিতে পাঠকের সংখ্যা কমে অর্ধেকে গিয়ে ঠেকেছে। অর্থাৎ মেরিয়েন্থালের অধিবাসীরা সব বিষয়ে আগ্রহ হারাতে হারাতে প্রায় নির্জীব হয়ে যাচ্ছিলেন।
একজন ভালো শিক্ষকের ধ্যানজ্ঞান হচ্ছে তাঁর পেশা, তিনি তাঁর ভেতরেই বাস করেন। করতে হয়, কারণ যে গুরুদায়িত্ব তিনি কাঁধে নিয়েছেন, সেটা যদি তিনি সঠিকভাবে করতে চান, তাহলে এটা ছাড়া তাঁর উপায় নেই। বেশির ভাগ পেশাজীবীর কাজ হচ্ছে ‘প্রোডাক্ট’ তৈরি করা, আর শিক্ষকেরা তৈরি করেন মানুষ। এই দুইয়ের পার্থক্য বলতে গেলে সেটা বাহুল্য হবে। অন্যদের ভুলে যে ক্ষতি হয়, সেটা আংশিক, পূরণীয়। আর শিক্ষকদের ব্যর্থতায় যে ক্ষতি হয়, সেটা সার্বিক, অপূরণীয়।
বোঝা গেল, পেশাটা তাঁদের কাছে কেবল অর্থোপার্জন ছিল না। বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী সুসান ডেভিড তাঁর এক গবেষণায় দেখেছেন, মূলত বেতন পাওয়ার জন্য চাকরি করেন কেবল ৪ শতাংশ পেশাজীবী। অন্যরা তাঁকে বলেছেন, চাকরি করে তাঁরা আর যেসব বিষয় পান—যেমন সহকর্মীদের সঙ্গ, কাজের চ্যালেঞ্জ, পেশাগত ক্ষমতায়ন ইত্যাদি—তা তাঁদের বেতনের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
অন্য যেকোনো পেশার চেয়ে শিক্ষকতা পেশায় এটা আরও বড় সত্য। একজন ভালো শিক্ষকের ধ্যানজ্ঞান হচ্ছে তাঁর পেশা, তিনি তাঁর ভেতরেই বাস করেন। করতে হয়, কারণ যে গুরুদায়িত্ব তিনি কাঁধে নিয়েছেন, সেটা যদি তিনি সঠিকভাবে করতে চান, তাহলে এটা ছাড়া তাঁর উপায় নেই। বেশির ভাগ পেশাজীবীর কাজ হচ্ছে ‘প্রোডাক্ট’ তৈরি করা, আর শিক্ষকেরা তৈরি করেন মানুষ। এই দুইয়ের পার্থক্য বলতে গেলে সেটা বাহুল্য হবে। অন্যদের ভুলে যে ক্ষতি হয়, সেটা আংশিক, পূরণীয়। আর শিক্ষকদের ব্যর্থতায় যে ক্ষতি হয়, সেটা সার্বিক, অপূরণীয়।
একজন ভালো শিক্ষক এটা জানেন। তাই তিনি কখনো তাঁর বেতন অনুপাতে কাজ করেন না। সারা দিন কাজ করলেও তিনি কখনো ওভারটাইমের কথা চিন্তা করেন না। তিনি যা করেন, নিজ দায়িত্বেই করেন। শিক্ষার্থীকে পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাইয়ে দিলেই হয়তো শিক্ষার্থী বা অভিভাবক খুশি, কিন্তু তিনি কখনোই শুধু পরীক্ষায় পাস করানোর জন্য পড়ান না। শিক্ষার্থীকে শাসন করলে অজনপ্রিয় হতে পারেন জেনেও তিনি প্রয়োজনে শাসন করতে ছাড়েন না। নিজে পড়াশোনা না করলে কেউ তাঁকে কিছু বলবে না, কিন্তু তিনি সেই সুযোগ নেন না। পরীক্ষার খাতা দেখা কিংবা ক্লাসে ফাঁকি দিলে কারও কিছু বোঝার উপায় নেই, কিন্তু তিনি তা দেন না। এ রকম আরও বহু বিষয় আছে। অর্থাৎ যিনি ভালো শিক্ষক হন, নিজের তাগিদেই হন। জোর করে তাঁর কাছ থেকে কিছু আদায় করা যায় না।
তবে বাংলাদেশ এই মুহূর্তে ভেতর থেকে তাগিদ অনুভব করে যাঁরা ভালো শিক্ষক হওয়ার চেষ্টা করছেন, তাঁদের সংখ্যা অঙ্গুলিমেয়। এই তাগিদ অনুভব না করার প্রধান কারণ হচ্ছে তাঁদের অপর্যাপ্ত বেতন ও সুযোগ-সুবিধা। যদিও ভালো শিক্ষকেরা কখনোই বেতন অনুপাতে কাজ করেন না, কিন্তু ন্যূনতম চাহিদা না মিটলে তো চলে না। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে যোগ্যতার অভাব। প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে, উচ্চতর শিক্ষার সুযোগ দিয়ে এবং গবেষণার প্রণোদনা দিয়ে তাঁদের যোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে। তৃতীয় কারণ হচ্ছে শিক্ষকদের হেয় চোখে দেখা। শিক্ষকদের বেতন-ক্ষমতা কম বলেই হোক, কিংবা তাঁদের যোগ্যতায় ঘাটতি থাকার জন্যই হোক, সমাজের অপরাপর মানুষ আর আগের মতো শিক্ষকদের সম্মান করছেন না; বরং সুযোগ পেলেই তাঁদের নির্মমভাবে হেনস্তা, এমনকি হত্যাও করছেন।
এ কারণেই সত্যিকারের শিক্ষকতা পেশা এখন অপস্রিয়মাণ। চাকরি চলে যাওয়ার পর মেরিয়েন্থালের অধিবাসীরা যেমন নির্জীব হয়ে গিয়েছিলেন, চাকরি থাকা অবস্থাতেই আমাদের শিক্ষকেরা তেমন ম্রিয়মাণ হয়ে যাচ্ছেন।
ইয়েটস একটা কবিতায় তাঁর প্রেমিকা মদ গনের উদ্দেশে বলেছেন, তাঁর যদি সোনালি ও রুপালি আলোয় কাজ করা একটা স্বর্গীয় কাপড় থাকত এবং সে কাপড়ের রং যদি নীল, মৃদু নীল বা কালো হতো, সে কাপড় যদি আঁধার, আলো বা আধো আলোয় তৈরি হতো, তাহলে তিনি সেটা মদ গনকে উপহার দিতেন। কিন্তু সেটা তো নেই। আছে কেবল স্বপ্ন। তিনি সেটাই মদ গনের পায়ের নিচে বিছিয়ে দেবেন। তবে স্বপ্ন যেহেতু ভঙ্গুর, সেখানে পা ফেলতে হবে খুব সাবধানে। শিক্ষকদের বেলায়ও তা-ই। শিক্ষার্থীরাও শিক্ষকদের পায়ের নিচে তাঁদের স্বপ্ন বিছিয়ে দেয়। ফলে, রাষ্ট্র ও সমাজকে খেয়াল রাখতে হবে, শিক্ষকেরা যেন সেখানে খুব সাবধানে হাঁটতে পারেন। সেটা না পারলে শিক্ষার্থীদের স্বপ্নের সঙ্গে আমাদের পুরো জাতির স্বপ্নও ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে।