অফিস অন্দর কেন কর্মিবান্ধব হবে না
একজন কর্মজীবীর দিনের বেশির ভাগটা অফিসেই কাটে। তাই অফিসের পরিবেশটাও হওয়া চাই কর্মিবান্ধব। শুধু চার কোনা একটা ভবন নয়, কর্মীদের জন্য সেরা পরিবেশ দিতে ভবনের নকশা থেকে পরিবেশ—সবকিছু নিয়েই ভাবছে অনেক প্রতিষ্ঠান। ঢাকা শহরের তেমন দুটি অফিস ভবনের খোঁজ জানাচ্ছেন স্থপতি সামিয়া শারমিন
দিনের অধিকাংশ সময় অফিসেই কাটে তামজীদের। সপ্তাহের ছয়টা দিনই অফিস কিউবিকলে শুধু কাজ আর কাজ। কিন্তু আসলেই কি তামজীদের কর্মক্ষমতার পুরোটা পায় তাঁর অফিস? কেমন হয় তামজীদের মতো কর্মীদের কথা চিন্তা করে অফিস অন্দরটাকেই যদি পাল্টে ফেলে কর্তৃপক্ষ? শুধু কর্মীই নয়, অফিস অন্দর কিন্তু অফিস ক্লায়েন্টদের প্রভাবিত করার ক্ষেত্রেও ভীষণ কার্যকর।
অফিস অন্দরসজ্জা নিয়ে সাধারণভাবেই আমাদের মধ্যে রয়েছে কিছু ভ্রান্ত ধারণা। বেশ কিছু গৎবাঁধা নিয়ম। সেসব দিয়েই আলোচনাটা শুরু করা যাক।
জোনিংয়ের কথাই বলি। কমবেশি অধিকাংশ অফিসেই দেখা যায়, পদমর্যাদা অনুযায়ী অফিস স্পেসের বিভাজন, যা শুরুতেই নতুন একজন কর্মীকে অফিস বিষয়ে দিতে পারে নেতিবাচক ধারণা। সহকর্মীদের সঙ্গেই আমরা দিনের সর্বোচ্চ সময়টা কাটাই। এখানে কর্মীদের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগটা যেমন জরুরি, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ অফিস বস ও কর্মীদের দূরত্ব কমানো। অনেক অফিসেই দেখা যায়, বসের বসার জায়গাটা একদমই বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে। অফিস অন্দরসজ্জায় বসের েটবিল বা রুমের স্ক্রিনিংয়ে আসতে পারে স্বচ্ছতা। তাহলে অফিস সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আসবে, প্রত্যেকে প্রত্যেকের ব্যবহার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকতে পারবে।
আমাদের সব দিন এক রকম কাটে না। আগাম কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই বদলে যেতে পারে আমাদের মনের আবহাওয়া; কিন্তু কাজ থেকে তো আর বিরতি নেওয়া যায় না। কখনো দিন বেশ ভালো গেলেও কখনো যেতে পারে খারাপ। কেউ খোলা জায়গায় কাজ করে আরাম পায়, কারও আবার পছন্দ বদ্ধ পরিবেশ। একই মানুষ আবার ভিন্ন ভিন্ন সময়ে, ভিন্ন ভিন্ন ওয়ার্কস্পেসে কাজ করে আরাম পায়। তাই অফিস অন্দরে দুই ধরনের কর্মপরিবেশই থাকতে পারে।
অফিসের আসবাবেও থাকতে পারে ভিন্নতা। অফিস ডেস্কের রোলিং চেয়ার, ক্যানটিনের হাই টুল কিংবা বিন ব্যাগ, বসার জায়গার ভিন্নতা বদলে দিতে পারে মনের অবস্থাও।
নিজেদের বাসাতেই কি আমরা একই রুমে সারা দিন থাকি? নিশ্চয়ই নয়। কখনো শুয়ে কাজ করি, কখনো বসে। কখনো তো টেবিল–চেয়ার ছেড়ে বারান্দার মেঝেতেই বসে পড়ি খাতা–কলম–ল্যাপটপ নিয়ে। ঠিক একইভাবে একই ডেস্কে, একই জায়গায় বসে, একইভাবে নানা ধরনের কাজ করাটা বেশ কঠিন। এখান থেকেই আসে ফ্লেক্সিবল ওয়ার্কস্পেসের ধারণা। তাই অফিসে থাকতে পারে ওয়ার্কস্পেসের দুটো ধরনই।
এমনকি অফিসের আসবাবেও থাকতে পারে ভিন্নতা। অফিস ডেস্কের রোলিং চেয়ার, ক্যানটিনের হাই টুল কিংবা বিন ব্যাগ, বসার জায়গার ভিন্নতা বদলে দিতে পারে মনের অবস্থাও।
অফিস অন্দরে আলো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এমন অনেক অফিস রয়েছে, যেখানে দিনরাত্রির পার্থক্য করাটাই মুশকিল হয়ে পড়ে, যা কর্মীদের শরীরেও ফেলে নেতিবাচক প্রভাব। একই আলোতে দীর্ঘক্ষণ কাজ করলে চোখেও চাপ পড়ে। দিনরাত্রির আলোর পার্থক্য বোঝাটাও জরুরি। তাই অফিস অন্দরে দিনের আলো যতখানি সম্ভব আনার ব্যবস্থা রাখা উচিত।
ব্লুজ হেডকোয়ার্টারের অন্দরে দিনের আলোকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। রাশেদ হাসান চৌধুরী বলেন, ‘দেহঘড়ি বলে একটা ব্যাপার আছে। সময়ের পরিবর্তনটা যদি অনুভব করতে পারি, তাহলে ক্লান্তি বা অবসাদ লাগাটা কমতে পারে
এমন অনেক বিবেচনা মাথায় নিয়েই অফিস অন্দরটা সাজিয়েছে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থা ব্লুজ কমিউনিকেশন। চিরাচরিত ধারণার বাইরে গিয়ে কিছু একটা করতে চেয়েছিল ব্লুজ। স্থপতি রাশেদ হাসান চৌধুরীর কাছে তাদের চাওয়া ছিল এমন একটা ওয়ার্কস্পেস, যেখানে প্রফুল্ল একটি কর্মপরিবেশ তৈরি সম্ভব।
ব্লুজ হেডকোয়ার্টারের অন্দরে দিনের আলোকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। রাশেদ হাসান চৌধুরী বলেন, ‘দেহঘড়ি বলে একটা ব্যাপার আছে। সময়ের পরিবর্তনটা যদি অনুভব করতে পারি, তাহলে ক্লান্তি বা অবসাদ লাগাটা আমাদের কমতে পারে। অন্যদিকে একই লাইট কন্ডিশনে একঘেয়েমি বেড়ে যায়।’
ব্লুজ হেডকোয়ার্টারের অফিস ইন্টেরিয়রে ফার্নিচারেও আনা হয়েছে ভিন্নতা। দ্বিতল এই অফিসের সিঁড়িটাই যেন একটা লাইব্রেরি! বই পড়ার অভ্যাসকে স্বাগত জানাতেই এই ভাবনা। এ প্রসঙ্গে স্থপতি রাশেদ হাসান চৌধুরী বলেন, ‘ধরে নিই, অফিসে হয়তো কেউ বই পড়ছে না। কিন্তু চোখের সামনে যখন অনেক বই থাকবে, কারও হয়তো কোনো বইয়ের নাম দেখেও আগ্রহ জাগতে পারে। কেউ একটা বই উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতেই পড়তে শুরু করতে পারে। আমরা শুধু অফিসটাকেই ডিজাইন করি না, আমরা অফিস কালচারটাকেও ডিজাইন করতে চাই।’
ইভেন্ট মৌসুমে গড়পড়তা অফিস সময়ের বাইরে রাতেও ব্লুজ কর্মীদের অফিসে থাকতে হয়। এ জন্য আছে ঘুমানোর জায়গাও। ডিজাইনের পরতে পরতে প্রতিটি স্পেসকে মাল্টিপারপাস করে তৈরির চেষ্টা ছিল। এমনকি ব্লুজের ইনহাউস কোন ইভেন্টে প্রজেক্টরের ব্যবহারের দরকার হলে অফিসের দেয়ালই হয়ে ওঠে পর্দা।
লম্বা আধা উন্মুক্ত করিডরের দুই পাশে অফিস পড। প্রতিটির মধ্যে এক টুকরা করে খোলা সবুজ, যা কখনো কর্মীদের খাবার জায়গা, কখনোবা আড্ডা, মিটিংয়ের স্থল।
ভিন্নধর্মী আরেকটি অফিস অন্দরের কথা বলি, যেখানে প্রাধান্য পেয়েছে সবুজ। বলছি টিচ ফর বাংলাদেশের অফিস ভবনের কথা। অফিসটার ডিজাইন করেছে স্টুডিও ঢাকা। চারদিকে আকাশছোঁয়া ভবনের মাঝখানে অফিসটি যেন মাটির কোলে, সবুজের কাছাকাছি।
সার্কুলেশন হিসেবে অফিসটিতে একটি লম্বা আধা উন্মুক্ত করিডর রয়েছে, যার দুই পাশে অফিস পড। প্রতিটি পডের মধ্যেই এক টুকরা করে খোলা সবুজ, যা কখনো কর্মীদের খাবার জায়গা, কখনোবা আড্ডা, মিটিংয়ের স্থল। কখনো আবার গিটারের টুংটাং শব্দে হয়ে ওঠে গানের আসরের স্থান। আবার কখনোবা খেলাধুলার জায়গা। এ ছাড়া এখানে রয়েছে একটা অ্যাম্ফিথিয়েটার। হঠাৎ বৃষ্টি থেকে বাঁচতে খোলা এই অ্যাম্ফিথিয়েটারটা আবার ছাউনি দিয়ে ঢেকে দেওয়ার ব্যবস্থাও আছে। এখানে প্রায় ১০০ কর্মীকে নিয়ে করা যায় কর্মশালা ও লেকচার সেশন।
স্টুডিও ঢাকার প্রধান স্থপতি মুহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, ‘অফিস ভবনটি তৈরির সময় আমাদের প্রধান বাধা ছিল সাইটে থাকা গাছগুলো। সেই গাছগুলোই পরে হয়ে ওঠে আমাদের ডিজাইন উপকরণ। আম, কাঁঠাল, কলা আর ডুমুরগাছে ঘেরা অফিসটায় কাজ করে মূলত তরুণ ছেলেমেয়েরা। তাদের কথা চিন্তা করেই মাটির কাছাকাছি এই স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে।
বদ্ধ অফিস স্পেস আর বাইরের উন্মুক্ত খোলা জায়গার সমন্বয় এনে দিয়েছে বেশ কিছু সুবিধা। এই যেমন গাছগাছালির ছায়ায় অফিসটা তুলনামূলক শীতল। অন্যদিকে টিনের ছাদে শুধু শব্দ শুনেই নয়, করিডরে এসে বৃষ্টির স্পর্শ পাওয়াও সম্ভব। মনিটরে টানা কাজ করতে করতেই বাইরে তাকালে চোখে শান্তি দেয় সবুজ। অফিস বিরতিতে চাইলেই খালি পায়ে সবুজ ঘাসে হেঁটে বেড়ানো যায়। বসে থাকা যায় গাছতলায়। জানালার ডিজাইনটাও এমন যে চাইলেই চৌকাঠে বসা যায়। অফিসজুড়েই বসার জায়গার কত যে ভিন্নতা! অফিসের ভেতরে বাস্কেটবল খেলারও ছোট্ট একখানা জায়গা আছে। অফিস শেষে চাইলে দল বেঁধে খেলাধুলাও করে নেওয়া যায়।
এভাবে কর্মীদের আরাম ও শারীরিক–মানসিক সুবিধার কথা চিন্তা করে যদি অফিসটা ডিজাইন করা যায়, তবে কর্মীদের কাজের স্পৃহাও বেড়ে যায় কয়েক গুণ